করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন নিয়ে বিশ্বে তোলপাড় চলছে। আগের ধরনগুলোর তুলনায় অমিক্রন যে আরও বেশি ছোঁয়াচে, তা প্রাথমিকভাবে বোঝা গেছে। ওমিক্রন মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যে কঠোর বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। করোনা বিধিনিষেধের অর্থ, অর্থনীতিতে সরাসরি প্রভাব। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সামগ্রিকভাবে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমক্রিনের ব্যাপক প্রভাবের ওপর নির্ভর করছে আগামী দিনের অর্থনীতির ভালোমন্দ। তারা এও আশঙ্কা করছেন যে, ২০২২ সালে পাঁচ হুমকির মুখে পড়বে বিশ্ব অর্থনীতি।

করোনার টিকা প্রতিরোধী ভ্যারিয়েন্ট
মার্কিন বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান জেপি মরগ্যান অবশ্য মনে করছে ওমিক্রনের প্রভাব ততটা প্রবল হবে না অর্থনীতিতে৷ তবে টিকা প্রতিরোধী নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট দেখা দিলে পরিস্থিতি আবার ওলট-পালট হতে পারে৷ ফাইজারের প্রধান নির্বাহী (সিইও) অ্যালবার্ট বোরলা বলেন, আমরা এখনও পর্যন্ত এমন কোনও ভ্যারিয়েন্ট পাইনি যা ভ্যাকসিন প্রতিরোধী। কিন্তু সামনে কোনও একটি ভ্যারিয়েন্ট হয়তো টিকা প্রতিরোধী হতে পারে’। করোনাভাইরাস নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট বিশ্বের অনেক দেশেই শনাক্ত যাচ্ছে। এর মধ্যে ডেল্টা, ল্যাম্বডা ও দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট অন্যতম। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে আসছেন, এমন কোনও ভ্যারিয়েন্ট আসতে পারে যেটি ভ্যাকসিন কাজ করবে না।

মহামারি প্রলম্বিত হওয়া
আইএমএফ বলছে, মহামারি প্রলম্বিত হলে মধ্য মেয়াদে তা বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে৷ তাদের বর্তমান পূর্বাভাসের চেয়ে আগামী পাঁচ বছরে জিডিপি পাঁচ দশমিক তিন ট্রিলিয়ন ডলার কমতে পারে৷ ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে প্রতিটি দেশে অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংস্থাটির প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ৷ তবে স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে এখন পর্যন্ত পাঁচ শতাংশ মানুষের টিকা সম্পন্ন হয়েছে৷

সাপ্লাই চেইনে ঘাটতি
বৈশ্বিক সরবরাহ নিগড়ে অংশগ্রহণকারীরা বারবার অনুমান করছেন যে ঘাটতি, অচলাবস্থা এবং সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যকার ভারসাম্যহীনতা ২০২২ সালের পরেও থাকবে এবং সম্ভবত তা আরো দীর্ঘ হবে। এরই মধ্যে জার্মানিসহ ইউরোজোনের গাড়ি নির্মাতা দেশগুলো যন্ত্রাংশ সরবরাহের ঘাটতিতে তাদের উৎপাদন কমাতে বাধ্য হচ্ছে৷ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, যানবাহন চলাচল এবং বৃহৎ শিল্পাঞ্চল লকডাউনের আওতায় পড়ায় জ্বালানির বৈশ্বিক চাহিদা দৈনিক তিন কোটি ব্যারেল কমেছিল। বিশ্ববাজারে এখন যা সরবরাহ আছে এটি তার ৩০ শতাংশ।
ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফী

ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ষষ্ঠ মাস ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে বাংলাদেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ০৫ শতাংশ। নভেম্বরে এই হার ছিল ৬ শতাংশের নিচে; ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এর অর্থ হলো, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে যে পণ্য বা সেবার জন্য ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সেই পণ্য বা সেবার জন্য ১০৬ টাকা ০৫ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক না হলে ২০২২ সালের বেশিরভাগ সময় জুড়েই মূল্যস্ফীতি মানুষকে ভোগাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা৷ বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘তথ্য বিশ্লেণে দেখা যাচ্ছে, গ্রামে-শহরে সব জায়গাতেই খাদ্যের চেয়ে অন্য পণ্য বা সেবার দাম বেশি বেড়েছে। এর অর্থ হলো, এই কিছু দিন আগে জ্বালানি তেলের যে দাম বাড়ানো হলো, তার প্রভাব খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিতে পড়েছে।

চীনের ধীরগতি অর্থনীতি
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি চীনের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার ধীরগতি বিনিয়োগকারীদের চিন্তায় ফেলছে৷ করোনা মহামারির অভিঘাত এড়াতে পারেনি চীন। স্থবিরতা নেমে এসেছে দুর্বার গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলা চীনা অর্থনীতিতে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, নির্মাণশিল্পে মন্দা, উপর্যুপরি করোনা বিধিনিষেধ ও রসদের ঘাটতি—এই তিন কারণই ছিল স্থবিরতার নেপথ্য কারণ, যার জেরে চীনের প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ থেকে নেমে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছিল। সমস্যা হলো, চীনের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়লে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দেশের অর্থনীতি গতি হারায়।

ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা
ইউক্রেনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সম্পর্কের ক্রম অবনতি হচ্ছে৷ এমনকি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটো দেশগুলোর অবরোধ ও যুদ্ধের আশঙ্কাও দেখছেন অনেকে৷ এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপ নর্ড স্ট্রিম টু গ্যাস পাইপলাইন বন্ধ করে দিলে তা সারা বিশ্বেই জ্বালানি সংকট তৈরি করবে৷ এতে তেলের মূল্য ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার ছাড়াতে পারে৷ সামনের দিনের বিশ্ব বাণিজ্য নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের উপরও৷ সূত্র: ডয়েচভেলে।